
আজকে আমি আপনাদের সামনে ফিস্টুলা নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো এবং হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় কিভাবে এটি সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য হয় তা ভিডিওর মাধ্যমে তুলে ধরব, ইনশাআল্লাহ। আমি যখন এটি নিয়ে প্রথম ভিডিও তৈরি করি তখন আমার জানা ছিল না বাংলাদেশে এর এত রোগী আছে, এমন কি আমি অনেক প্রবাসীর ফোনও পেয়েছি যারা এই সমস্যায় ভুগছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, অধিকাংশ রোগীই প্রথমেই যখন মলদ্বারের আশেপাশে কোন ফোঁড়া বা ছিদ্র দেখা দেয় এবং তা থেকে পুঁজ নির্গত হওয়া শুরু করে তখন তারা কোন ফার্মেসি ম্যান বা ডাক্তারের কাছে যান তখন ফার্মেসি ম্যান বা ডাক্তার এটা কি সাধারন ফোঁড়া না অন্য কিছু তা না বুঝেই এন্টিবায়োটিক দিয়ে দেন, এর ফলে এটি ভিতরে চাপাপড়ে যায়, তখন এটি অন্য দিকে নালি তৈরি করে বা একই দিকে আরো মারাত্মক ভাবে দেখা দেয়। অভিজ্ঞ এলোপ্যাথিক ডাক্তাররাও ফিস্টুলার কেসে এন্টিবায়োটিক খেতে নিষেধ করেন।
ফিস্টুলা হওয়ার কারণ?
সাধারণত মলদ্বরের ভিতরে প্রদাহ বা সংকোমণের কারণে এই সমস্যাটি দেখা দেয়। বিশেষ করে, যারা দীর্ঘদিন যাবৎ কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগছে, মলত্যাগ করার সময় অনেক চাপ দিয়ে মলত্যাগ করতে হয়। এই চাপের কারণে অনেক সময় মলদ্বার ফেটে যায়, যাকে ফিসার বলা হয়। এই ফাটা থেকেও এটি দেখা দিতে পারে। আবার অনেক সময় পাইলসের কারণে মলদ্বারে ফোঁড়া হয় এবং এই ফোঁড়া থেকে পরবর্তীতে এটি দেখা দিতে পারে। যারা দীর্ঘদিন যাবৎ ডায়রিয়ায় ভুগছে তারাও এতে আক্রান্ত হতে পারে। যারা ফলমূল, শাক সবজী ইত্যাদি কম খায় তাদেরও এই সমস্যাটি দেখা দিতে পারে। তবে আমি এমন কিছু মহিলা রোগী পেয়েছি যারা গর্ভাবস্থায় বা বাচ্চা প্রসবের পর থেকে পাইলস বা ভগন্দরে আক্রান্ত হয়েছেন।
আরো কিছু কারণ:
কিছু রোগের কারণেও এটি দেখা দিতে পারে, যেমন: অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, বিভিন্ন সংক্রমণ, অনেক সময় যক্ষ্মারোগের শেষেও এটি দেখা দিতে পারে, Crohn’s disease বা অন্ত্রের প্রদাহ থেকেও এটি দেখা দিতে পারে (Crohn’s disease-এ আক্রান্ত প্রায় ২৫% লোকের এটি হয়), যৌন রোগ থেকেও এটি দেখা দিতে পারে (এর কারণে অনেক সময় যৌন দুর্বলতাও দেখা দেয়) এবং ক্যান্সারের কারণেও এটি দেখা দিতে পারে।
যে বয়সের মানুষ ফিস্টুলায় বেশি আক্রান্ত হয়:
যেকোনো বয়সেই এটি দেখা দিতে পারে, তবে সাধারণত ২০ থেকে ৬০ বছরের মানুষ বেশি আক্রান্ত হয় এবং মহিলা ও পুরুষ উভয়ই আক্রান্ত হয়।
ফিস্টুলার লক্ষণ বা উপসর্গগুলো হলো:
- ঘন ঘন মলদ্বারে ফোঁড়া হওয়া এবং ফোঁড়া থেকে হলদে, ঘন, পানির ন্যায় পাতলা বা পিণ্ডময় পুঁজ নির্গত হওয়া।
- মলদ্বারের চারপাশ ব্যথা করে, স্পর্শকাতরতা দেখা দেয়, চুলকায়, জ্বালাপোড়া করে, দপদপ করে, ফুলে যায়, সাধারণত এই সমস্যাগুলো যখন এতে পুঁজ জমা হয় তখন বৃদ্ধি পায় এবং পুঁজ বের করে দিলে কমে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে মলত্যাগের সময় বা পরে এই সমস্যাগুলো বৃদ্ধি পায়। আবার অনেকের এতে কোন ব্যথা বা জ্বালা যন্ত্রণা থাকে না।
- অনেকের ক্ষেত্রে মলদ্বারের পাশে একটি শক্ত গুটিকা দেখা দেয়, যা কিছুদিন পর পর ফুলে যায়, তখন প্রচণ্ড ব্যথা হয়, ব্যথার কারণে বসতে পারে না, অনেকের ক্ষেত্রে জ্বরও আসতে পারে। যখন এটি ফেটে যায় এবং তা থেকে পুঁজ বা রক্ত নির্গত হয় তখন আরাম পায়।
- এর থেকে অনেক সময় রক্তপাত হতে পারে বা মলের সাথে রক্ত যেতে পারে।
- অনেকের এর সাথে বুকের সমস্যা দেখা দেয় অর্থাৎ ভগন্দরের সাথে ফুসফুস বা হার্ট আক্রান্ত হয়।
- এর কারণে জ্বর, শীত লাগা, দুর্বলতা বা যৌন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- অনেকের মলদ্বারের জায়গাটি সবসময় ভিজা থাকে, কাপড় ভিজে যায়, এ জন্য তাকে সবসময় টিস্যু দিয়ে রাখতে হয়।
- অনেকের মলদ্বার দিয়ে পুঁজ আসে। (এদের মলদ্বারের বাহিরে কোন মুখ থাকে না।)
- অনেকের মলদ্বারের পাশে আরেকটি মুখ থাকে, মলত্যাগের সময় দুইটি দিয়েই মল আসে, বাতাস আসে, অনেকের ক্ষেত্রে এই মুখ দিয়ে ক্রিমিও চলে আসে।
ফিস্টুলার জটিলতা:
অনেকের ক্ষেত্রে এতে কোন জ্বালাযন্ত্রণা থাকে না তাই তারা বছরের পর বছর এটি বিনাচিকিৎসায় রেখে দেয়, এটা খুবই ভুল কারণ এটি বিনাচিকিৎসায় রেখে দিলে এটি বিভিন্ন দিকে নালী তৈরি করতে থাকে যা সাধারণত বুঝাযায় না, এবং যখন এটি ধরা পরে তখন এর চিকিৎসা জটিল হয়ে পড়ে। যাদের এই সমস্যাটি জটিল আকার ধারন করেছে তাদের মলত্যাগের সময় অত্যন্ত জ্বালাপোড়া হতে পারে। রোগী যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়ে, পায়খানা করতে ভয় পায়। পায়খানার সময় মলের সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে রক্ত বা পুঁজ নির্গত হতে পারে। রোগীর হাঁটাচলায় কষ্ট হতে পারে। এই রোগে দীর্ঘদিন পর্যন্ত ভুগতে থাকলে সেপটিক জ্বর দেখা দিতে পারে। এটি ধীরে ধীরে গ্যাংগ্রিনে পরিণত হতে পারে। অনেক সময় মলদ্বার হতে রোগ বিস্তার লাভ করে গোটা সরলান্ত্র ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
আরেকটি মারাত্মক জটিলতা হলো, একাধিকবার এর অপারেশন করানোর ফলে যক্ষ্মা, ফুসফুসের সমস্যা, হার্টের সমস্যা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
সার্জারি বা অপারেশনের মাধ্যমে ফিস্টুলার চিকিৎসা:
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে সার্জারি ব্যতীত এর অন্য কোন চিকিৎসা নাই। এমন অনেক রোগী আছে যারা কয়েক বার মলদ্বারের ফিস্টুলার বা ভগন্দরের অপারেশন করিয়েছেন কিন্তু পুনরায় এটি আরো জটিল ভাবে দেখা দিয়েছে। এমনও দেখা গেছে যাদের আগে একটি মুখ বা ছিদ্র ছিল অপারেশন করার পর দুই থেকে তিনটি মুখ বা ছিদ্র দেখা দিয়েছে।
ফিস্টুলার চিকিৎসা:
বর্তমানে আমি প্রচুর ফিস্টুলার রোগী পাচ্ছি যারা সবাই একই কথা বলছে, প্রথমে আমার মলদ্বারের পাশে একটা ফোঁড়া বা শক্ত গুটিকা দেখা দিয়েছিল। সবাই এটাকে সাধারণ ফোঁড়া ভেবে এর চিকিৎসা নেয় অর্থাৎ অনেকে চুনদিয়ে বা অন্য কিছু দিয়ে এটা ফাটায়, আবার অনেকে ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তারও সাধারণ ফোঁড়া ভেবে তাকে এন্টিবায়োটিক দিয়ে এটি বসিয়ে দেয়া বা সার্জি করার করে কিন্তু পরে দেখা যায় এটি কোন সাধারণ ফোঁড়া না, এর থেকে পুঁজ পানি বের হতে থাকে, অনেকের ক্ষেত্রে এই পুঁজ পানি সবসময় বের হতে থাকে, যার কারণে তাদেরকে সবসময় কাপড় পরিবর্তন করতে হয় বা ঐ যায়গায় টিস্যু দিয়ে রাখতে হয় আবার কারো কারো ক্ষেত্রে কিছু দিন পর পর ঐ স্থানটা ফুলে যায়, ব্যথা করে তারপর তা থেকে কিছুটা পুঁজ পানি বের হয়, পুঁজ পানি বের হওয়ার পর সে আরাম পায়, পুঁজ পানি বের হওয়ার পর এটা আবার মিশে যায় কিন্তু দেখা যায় কিছু দিন পর আবার দেখা দেয়, এভাবে চলতে থাকে। মজার বিষয় হলো রোগীরা যখন নিশ্চিত হয় তিনি ফিস্টুলায় আক্রান্ত তখন তারা কোন ডাক্তার বা সার্জনের কাছে গেলে, তারা তাদেরকে প্রথমে ১৪ দিনের জন্য এন্টিবায়োটিক দেন এবং ১৪ দিন পর আবার দেখা করতে বলেন। ১৪ দিন পর তারা যখন ডাক্তার বা সার্জনের কাছে যান তখন তারা বলেন এটা সার্জারি বা অপারেশন করাতে হবে, সার্জারি বা অপারেশন ছাড়া এর কোন চিকিৎসা নাই। কিন্তু যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয় সার্জারি বা অপারেশন করালে কি এটি একবারেই ভালো হয়ে যাবে? আর হবে না? তারা এর নিশ্চয়তা দেয় না। কারণ দেখা গেছে বা আমার কাছে অনেক পেশেন আছে যারা কয়েক বার সার্জারি বা অপারেশন করিয়েছেন, এমনকি তারা লেজার অপারেশনও করিয়েছেন। কিছু দিন আগে আমাকে একজন রোগী ফোন দিয়ে বলেন তিনি তার ফিস্টুলার জন্য লেজার অপারেশন করিয়েছেন কিন্তু অপারেশনের কিছু দিন পর থেকে তার আবার পুঁজ পানি যাওয়া শুরু হয়, তখন যিনি তার অপারেশন করেছেন তার কাছে গেলে তিনি তাকে নতুন করে এন্টিবায়োটিক দিয়ে দেন, এভাবে কয়েকবার এন্টিবায়োটিক খাওয়ার পরেও যখন তার পুঁজ পানি পড়া বন্ধ হচ্ছে না তখন তাকে নতুন করে অপারেশনের কথা বলা হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন ফিস্টুলা সার্জারি বা অপারেশন করানোর পরেও সাধারণত ভালো হয় না, এর উত্তর হচ্ছে, আমরা আমাদের মলদ্বারের পাশে যে মুখটি দেখি এটা ফিস্টুলার একটি শাখা, অনেকের এ ধরনের কয়েকটি শাখা থাকে, এর শিকড় কিন্তু মলদ্বারের ভিতরে থাকে যা সার্জারি বা অপারশনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ কেটে ফেলা সম্ভব হয় না বা লেজারের মাধ্যমেও সম্ভব হয় না, আর সবচেয়ে বড় কথা যে কারণে আপনার এই সমস্যাটি দেখা দিয়েছে তা সার্জারি বা অপারশন বা লেজারের মধ্যে সে কারণটি দূর করা সম্ভব হয় না, শুধুমাত্র রোগের কারণে যে সমস্যাটি দেখা দিয়েছে তা দূর করা হয়, আর রোগটি থেকেই যায়, উদহারণস্বরুপ আপনার বাসার পাশে যদি একটি বট গাছ থাকে আর আপনি যদি বট গাছের সবগুলো ঢাল কেটে দেন কিন্তু গোড়া থেকে যায় তাহলে দেখবেন কিছুদিন পর সেই গোড়া থেকে নতুন ঢাল জন্মাচ্ছে। ফিস্টুলার ক্ষেত্রেও একই কথা, গোড়া থাকলে তার থেকে নতুন মুখ বা নালী দেখা দিবে এবং তা থেকে পুঁজ পানি নির্গত হবে।
তাই আমি বলবো, যারা ফিস্টুলায় আক্রান্ত হয়েছেন তারা একজন আদর্শ হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের কাছে ধৈর্য ধরে চিকিৎসা নিলে আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারবেন, ইনশাআল্লাহ্। আমাকে অনেকেই ফোন দিয়ে বলেন আমি হোমিও চিকিৎসা নিয়েছি বা নিচ্ছি কিন্তু কোন উপকার পাচ্ছি না বা পাই নাই। এর কারণ বর্তমানে অনেক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক হোমিওপ্যাথির নাম দিয়ে পাইলস, পলিপাস, ফিস্টুলা এসিড দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে বা ইনজেকশনের মাধ্যমে শুকিয়ে ফেলছে বা এক সাথে একাধিক হোমিওপ্যাথিক ঔষধ দিচ্ছে যা খুবই মারাত্মক চিকিৎসা। তাদের স্লোগান হল ৭ দিনের মধ্যে স্থায়ী আরোগ্য। তারা যে চিকিৎসা করে তার মাধ্যমে আপনি কয়েক মাস বা কয়েক বছর ভালো থাকতে পারবেন কিন্তু এক সময় এটি মারাত্মক ভাবে দেখা দিতে পারে যা আরোগ্য করা খুবই কঠিন। এমন কি আপনি ক্যান্সারেও আক্রান্ত হতে পারেন। হোমিওপ্যাথিতে এধরণের কোন চিকিৎসা সাপোর্ট করে না। যারা হোমিওপ্যাথির নাম দিয়ে এ ধরণের চিকিৎসা করছে তারা হলো অপহোমিওপ্যাথ। তাদের থেকে সাবধান থাকতে হবে। তাই আপনাকে অবশ্যই একজ আদর্শ হোমিওপ্যাথিকের কাছে চিকিৎসা নিতে হবে।
এখন প্রশ্ন হলো আপনি কিভাবে একজন আদর্শ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসককে চিনবেন?
একজন আদর্শ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক আপনার সকল সকল সমস্যা শুনবেন এবং লিপিব্ধ করবেন। কি কারণে আপনার এই সমস্যাটি দেখা দিয়েছে তা খুঁজে বেরকরার চেষ্টা করবেন। এনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় বংশগত কারণেও ফিস্টুলা দেখা দিতে পারে, তখন তিনি বংশগত দোষ দূর করারা চিকিৎসা দিবেন। এছাড়াও আপনার সকল লক্ষণ নিয়ে ভালোভাবে এনালাইসিস করে আপনাকে একটি নির্দিষ্ট ঔষধ এবং এর সাথে কিছু সাহায্যকারী ঔষধ দিবেন। সবগুলোই মুখে খাওয়ার জন্য। তিনি আপনাকে লাগানের জন্য মলম জাতীয় কোন ঔষধ দিবেন না। কারণ ফিস্টুলাতে মলম লাগানের ফলে ফিস্টুলাটির মুখটি বন্ধ হয়ে যায়, এরফলে অন্য দিক দিয়ে আরেকটি মুখ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়, কারণ আমরা জানি পুঁজের ধর্ম হলো সে শরীরে থাকবে না, সে যেভাবেই হোক শরীর থেকে বের হবেই, তাই যখন বাহিরের মুখটি বন্ধ হয়ে যায় তখন সে বের হওয়ার জন্য নতুম মুখ তৈরি করে। সুতরাং যারা পাইলস, পলিপাস বা ফিস্টুলায় আক্তান্ত হয়েছেন তারা একজন আদর্শ হোমিওপ্যাথের কাছে চিকিৎসা নেয়ার জন্য আনুরোধ করবো। যারা আমার কাছে চিকিৎসা নিতে চান তারা আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।